আরবি পড়তে গিয়ে দেখি মাঝেমধ্যেই আটকে যাচ্ছে। সব নিয়মকানুন ঠিকমতো মনেও নেই। মুখস্ত যা ছিল তার বেশিরভাগও বেমালুম ভুলে বসে আছি।
অথচ আমি আরবি পড়তে শিখেছিলাম সেই ছোটবেলায়, প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়তাম তখন। আমাদের দেশের মুসলিম পরিবারের আর দশটা ছেলেমেয়ে সচরাচর যেভাবে শেখে সেভাবে। স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব বেশ যত্ন সহকারেই আমাকে শেখাচ্ছিলেন।
এরই মাঝে চলে যেতে হলো আরেক শহরে। সেখানে আরেকজন হুজুরের কাছে বাদবাকি পড়া শেষ করি। কিন্তু অনেক বাঙালি মুসলিম পরিবারেই যেমনটা হয়ে থাকে, একবার কুরআন খতম করার পর আমার কুরআন পড়াও যেন এক প্রকার ‘খতমই’ হয়ে গেল বলা চলে।
রমযান মাসের কথা বাদ দিলে বছরের বাদবাকি সময় জুড়ে বাসায় থাকা কুরআনে ধুলো জমে থাকত বললে মনে হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। বছরের পর বছর ধরে চর্চা না থাকলে জানা জিনিসও মানুষ ভুলে যেতে বাধ্য। কুরআনও এর ব্যতিক্রম নয়। শৈশবে ভালোভাবে শেখার পরেও আরবি পড়া আমি প্রায় ভুলেই যেতাম যদি না মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা বাধ্যতামূলক একটা বিষয় হিসেবে না থাকত।
জাতীয় শিক্ষাক্রমের ইসলাম শিক্ষা বইয়ের বাইরেও ক্লাস সিক্স থেকে আরবি ভাষা আলাদা একটা সাবজেক্ট হিসেবেও আমাদের স্কুলে পড়ানো হতো। পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় নম্বর তুলতে পারলেও ভাষা-শিক্ষা অবান্ধব সিলেবাস ও পাঠ্যবই এবং ক্লাসে দুর্বল পাঠদানের কারণে সেখান থেকে ভাষা হিসেবে আরবির তেমন কিছুই আমি শিখতে পারিনি।
স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার পরে আরবির একটা অক্ষরও আর পড়া লাগেনি, ফলে এতদিন যা পারতাম তা-ও দ্রুত ভুলে যেতে লাগলাম। সময় গড়ানোর সাথে সাথে বিস্মৃতির মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে লাগল।
অনেক বাঙালি মুসলিম পরিবারেই ছেলেমেয়েদের আরবি পড়তে শেখানো হয় মূলত একটা কালচার হিসেবে। মুসলমান ঘরের সন্তান অথচ আরবি পড়তে পারবে না তা তো হয় না! কিন্তু ছোটবেলায় পড়তে শেখার পর এই চর্চাকে যে জীবনভর ধরে রাখতে হয় তা আমাদের পরিবারসমূহে তেমন একটা গুরুত্ব পায় বলে মনে হয় না।
ঘটনাচক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মাঝামাঝি পর্যায়ের দিকে এসে ইসলামের প্রতি আমার আবারও আগ্রহ জন্মাতে আরম্ভ করে। কিন্তু ততদিনে যা ভোলার তা তো ভুলেই গিয়েছি। এবার আবারও নতুন করে আরবি শিখতে শুরু করলাম। একা একা।
ওই সময়ে আমি অল্প অল্প করে কুরআন তিলাওয়াতের রেকর্ড শুনতে শুরু করি। আব্দুর রহমান আস-সুদাইস, সৌদ আশ-শুরাইম, আলী আব্দুর রহমান আল-হুযায়ফী, সা’দ আল-গামিদী – এদের তিলাওয়াতই বেশি শোনা হতো। গামিদীর তিলাওয়াতের সাথে সাথে আরবি টেক্সট দেখায় এরকম একটা প্রোগ্রাম তখন কম্পিউটারে নামিয়েছিলাম। এটা বেশ কাজে দিয়েছিল। আজকাল যাকে সবাই অ্যাপ বলে তখনকার দিনে তাকে প্রোগ্রাম নামেই মানুষ চিনত।
বাসায় তখনো ইন্টারনেট কানেকশন ছিল না। ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ল্যাবে প্রথমে মূল ফাইল নামাতাম। এরপর ফ্লপি ডিস্কে ভরে নিয়ে এসে তা বাসার কম্পিউটারে কপি করে রাখতাম। ফাইল বেশি বড় হলে ওটাকে ভেঙে একাধিক ফ্লপি ডিস্কে নিয়ে তারপর বাসায় গিয়ে আবারও জোড়া লাগাতাম। শেষের দিকে পেন ড্রাইভ যখন আসল তখন ফাইল কপি করা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল।
ওই একই সময়ে রমযান মাসে মক্কার হারাম শরিফের তারাবীহ নামাযের সরাসরি সম্প্রচারও আমি নিয়মিত দেখতে শুরু করি। তখন রমযান পড়ত শীতের সময়ে। বাংলাদেশে রাত সাড়ে এগারোটার একটু পরে মক্কায় এশার নামায শুরু হতো। বিতর সহ শেষ হতে হতে দেড়টার মতো বেজে যেত। আমার রুমে ডিশ লাইন সহ কম্পিউটারে টিভি কার্ড লাগানো ছিল, ফলে দেখতে কোনো সমস্যাই হতো না।
তারাবীহর ওই লাইভ টেলিকাস্টে আরবি তিলাওয়াতের সাথে সাথে ইংরেজিতে সাবটাইটেলও থাকত। সেখান থেকেই অনুবাদের পাশাপাশি কুরআনে বারবার পুনরাবৃত্তি হয় এরকম অনেক আরবি শব্দের অর্থও আমি একটু একটু করে শিখতে শুরু করি।
তারও পরে কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ পড়ায় মন দিই। মুহসিন খান ও তাকিউদ্দিন হিলালির করা সেই অনুবাদে অনেক আরবি শব্দের সরাসরি অনুবাদ না করে রোমান হরফে আরবি সেই শব্দটি লিখে পাশে ব্র্যাকেটে তার অর্থ দেওয়া আছে। সেখান থেকেও কিছু শিখি। অনুবাদ পড়তে গিয়ে বাক্যের প্যাটার্ন মিলিয়ে আরও কিছু শব্দের অর্থ শিখে ফেলি। এর বাইরেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় পড়তে গিয়েও আরও কিছু আরবি শব্দের অর্থ শিখতে আমি সক্ষম হই। এভাবে কয়েকশ’ শব্দের অর্থ আমি শিখতে পেরেছিলাম বলে আমার ধারণা।
এরও অ-নে-ক পরে গিয়ে আরবি ভাষা শেখার একটা কোর্সে ভর্তি হই। অনলাইন লার্নিং তখনো আসেনি, ফলে সশরীরে গিয়েই ক্লাস করতে হতো। প্রতি শুক্রবার দুপুরে। এক-দেড় ঘণ্টার মতো করে। সারা সপ্তাহ অফিস করার পর ছুটির দিনে এভাবে নিয়মিত ক্লাস করা বেশ কষ্টকর একটা কাজ। সেখানে ভালোই শিখছিলাম, কিন্তু কোর্সের সার্বিক অগ্রগতি আমার প্রত্যাশার তুলনায় যথেষ্ট শ্লথ ছিল।
কর্মজীবি মানুষ ছাত্রজীবনের মতো তাড়াতাড়ি শিখতে পারে না। হোমওয়ার্কও ঠিকঠাকমতো করে না। আগ্রহ থাকলেও একইসাথে গা ছাড়া একটা ভাবও সেখানে দেখা যায়। শিক্ষকের কোনো দোষ আমি এখানে দেব না। তিনি আমাদেরকে শেখানোর ব্যাপারে যথেষ্টই আন্তরিক ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, এক বছরে মদিনা অ্যারাবিক নামে পরিচিত সিরিজের প্রথম বইটা শেষ করেছিলাম। কিন্তু আমার নতুন পারিবারিক বাস্তবতায় এর বেশি টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আমি তখন ছিলাম না। আর তার ঠিক পরেই তো বিদেশেই চলে গেলাম।
পরবর্তীতে ওই ভিত্তির উপরে ভর করে আমার আরবিকে আরেকটু সমৃদ্ধ করার অল্পস্বল্প চেষ্টা চালিয়েছি। অনেক শিখেছি তা বলব না, তবে পুরোপুরি না হলেও কুরআনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ অনুবাদের সাহায্য ছাড়াই এখন আমি মোটামুটি বুঝতে পারি। কুরআনের বাইরের আরবি অবশ্য আমি আজও খুব একটা বুঝি না।
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী না হয়ে থাকলে অনারব ব্যক্তিদের আরবি না শিখলেও চলে। মূলত ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই মুসলিম পরিবারের প্রায় প্রতিটি বাচ্চাকে নিয়ম করে আরবি পড়তে শেখানো হয়। কিন্তু ‘হুজুরের কাছে পড়া’ শেষ করার পর নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এদের প্রত্যেকের অভ্যাসে পরিণত করতে না পারলে তাদের পরিণতিও আমার অতীতের মতো হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
আর আমরা অভিভাবকেরা নিজেরাই যদি নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত না করি তাহলে আমাদের দেখাদেখি আমাদের সন্তানেরাও একসময় কুরআন তিলাওয়াতে অনিয়মিত হয়ে পড়বে। বেশিরভাগ বাঙালি মুসলিম পরিবারে সচরাচর এমনটাই হয়ে থাকে। নিজে যা করি না তাদের কাছে তা আশা করি কীভাবে?
আমাদের পরিবারসমূহের মধ্যে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের এই অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি সামান্য কিছু হলেও আরবি ভাষা শিখতে ও শেখাতে পারলে আরও ভালো। খুব বেশি না, নামাযে সবসময় পড়া হয় এরকম শব্দসমূহের অর্থ দিয়ে হলেও শুরু করা যেতে পারে। কুরআন শুনে সরাসরি বোঝার মতো স্বর্গীয় স্বাদ একবার যে পেয়েছে একমাত্র সে-ই বোঝে এতদিন ধরে কি অসাধারণ এক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থেকে সে বঞ্চিত ছিল।